দুখু মিঞা
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
চুরুলিয়া কোনো বিত্তশালী গ্রাম নয়, মানি; তবু সেখানে ছিল মার্জিত রুচিসম্পন্ন শিক্ষিত একটি ভদ্রসমাজ। প্রমাণ_ ছোট গ্রাম, তবু মক্তব আছে, মক্তব বসছে গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য, সুশিক্ষিত মৌলভি আছেন, পড়ুয়াদের আনাগোনা চলছে। গ্রামে বজলে করিমের মতো লেখাপড়া-জানা মানুষও রয়েছেন। একেবারে মূর্খদের গ্রাম তো একে কোনোভাবেই বলা চলে না। অর্থাৎ চুরুলিয়া যদিও অজপাড়াগাঁ এবং শহর থেকে অনেক দূরে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তবু এ গ্রামকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলবার উপায় নেই। এক ধরনের শিক্ষা রুচির আলো গ্রামের মানুষজন ধরে রেখেছিল। দুঃখের সংসারে মানুষ হতে থাকলেও নজরুল এ আলোকের আভার মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছিলেন।
দুখু মিঞার শৈশবের কোনো ছবি আমাদের সামনে ধরা নেই। দুখু মিঞাদের কোনো শৈশব থাকে না। গরিবের ছেলে দেশের দরিদ্র জনতার ভিড়ে হারিয়ে যায়, কে তার খোঁজ রাখে? আর যদি-বা সে দৈবাৎ কপালগুণে বিখ্যাত হয়ে যায় হঠাৎ তা হলে তখন অবশ্য লোকে চেনে তাকে, কদর করে। কিন্তু তার ফেলে আসা শৈশব তো তত দিনে কোথায় হারিয়ে গেছে! কবি নজরুল ইসলাম দুখু মিঞার কোনো জীবনী লেখেননি, কোনো গল্পও কখনও রচনা করেননি। দুখু মিঞার শৈশব কেউ আমাদের জন্য লিখে রেখে যায়নি।
গ্রামের ছেলে। খোলামেলা, মুক্ত প্রকৃতির ভেতরে বেড়ে ওঠে। দুরন্ত হওয়াটাই তার জন্য স্বাভাবিক, জানি। তা বলে কি গাঁয়ের সব ছেলেই দুরন্ত? নজরুলের কিশোর-জীবনের ছবি আমরা চিনি : রানীগঞ্জে পড়ছে, দুখু মিঞা এরই মধ্যে নজরুল হয়ে গেছে; তখন সে ডানপিটে বটে। কিন্তু পাঁচ বছরের দুখু মিঞা? তখনও কি সে খুব দুরন্ত? বাল্যকালে, মনে হয়, নজরুল শান্ত ছিলেন। এমন ভাববার কারণ, তার ছেলেবেলার পরিবেশ। তার হাতেখড়ি হয়েছিল ঠিক বয়সে। কে তাকে প্রথম অক্ষর-পরিচয় করিয়েছিলেন? সম্ভবত, বাবার কাছেই ছেলের প্রথম পাঠশিক্ষা। লেখাপড়া-জানা সব গৃহস্থ বাড়িতে যেমন, এক্ষেত্রেও তেমনি। অক্ষরজ্ঞান হলো, এক-দুই গুনতে শিখলে, তো এবারে যাও স্কুলে। চুরুলিয়ায় স্কুল ছিল না, ছিল মক্তব। ছেলেকে মক্তব্যে পাঠিয়েছিলেন কাজী ফকির আহমদ। বালকের স্মৃতিশক্তি ছিল চমৎকার। মক্তবে মৌলভির কাছে কোরআন পড়তে শেখা আর ফার্সি ভাষা শিক্ষার গোড়াপত্তন। কিন্তু বই মুখে নিয়ে বসে থাকলে কি গরিবের ছেলের চলে? বাড়ির টুকটাক এটা-ওটা ফাই-ফরমাশ খাটা আছে। বাবার পিছু পিছু মাজারে যাওয়া, হয়তো মনের আনন্দে পিদিম হাতে নিয়ে শখ মেটানো। না ডাকতেই নিজের খেয়ালখুশিতে ওজুর পানির বদনা এগিয়ে দেয়া। ঠিকঠাক অবিকল এরকমটাই যে ঘটত তা কে বলবে? সবটুকুই আমাদের কল্পনা। তবে এমন কল্পনার ভিত্তি আছে। দুখু মিঞাদের সংসারে এমনটাই সাধারণত হয়ে থাকে, যুগ যুগ ধরে এরকমই হয়ে আসছে কিনা, তাই। প্রয়োজন ও অভাবের চাপ শিশুকেও অনেক কিছু বুঝতে শেখায়। নিজের ভেতরে এ বালকও তাই গোপন দায়িত্ববোধের তাড়া নিশ্চয়ই এড়াতে পারেনি। না হলে অকস্মাৎ বাপ মারা গেল যখন, তখন দুখুর বয়স তো সবে আট। অথচ মাত্র দু’বছরের ভেতরেই দশম বর্ষীয় এ কিশোর তার পরিবারের একজন দায়িত্ববান সদস্য হয় কোন মন্ত্রবলে? সে কারণেই বলছিলুম, পরবর্তী জীবনের বেপরোয়া উদ্দাম নজরুল ডানপিটে হওয়ার কোনো অবকাশ পায়নি দুখুর বয়সে।
মক্তবে তো ছেলে যাচ্ছে পাততাড়ি বগলে নিয়ে, কিন্তু পড়ছে কী? মক্তবে পড়ানো হতো আরবি-ফার্সি। তবে ভাষা শিক্ষা ততটা নয়, যতটা ধর্মশিক্ষা। মাতৃভাষা বাংলা অবশ্য বাদ পড়ত না। বাবার চাচাতো ভাই কাজী বজলে করিম ফার্সি ও উর্দু জানতেন চমৎকার, বাংলাতেও ভালো দখল ছিল। তদুপরি কবিতাপাগল মানুষ। চাচা-ভাইপোর সম্পর্ক মধুর ছিল। শিশুর মনে ভাষার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে দিয়েছিলেন এ পিতৃব্য। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বাবা কাজী ফকির আহমদ মারা গেলেন। তারিখ ১৩১৪ সনের ৭ চৈত্র। সংসার চলে না, বাবা নেই, দারিদ্র্য বাড়ছে। এক বছর পর মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো দুখু। ব্যস, সঙ্গতি শেষ, লেখাপড়াও খতম। গরিবের ছেলের বেশি লেখাপড়ার দরকার কী? এতটুকুই যথেষ্ট! এখন যা প্রয়োজন তা হলো উপার্জন, পয়সা উপায় করা। যেখান থেকে দু’চার পয়সা মেলে সেখানেই দৌড়ানো; সংসারের ওটুকুই লাভ। ১০ বছর বয়সে ধনীর দুলালরা যখন পৃথিবী কাকে বলে জানে না, সেই বয়সেই দুখুকে ঘরের ভাবনা ভাবতে হয়। ওই তো একরত্তি ছেলে! ছুটবেই আর কোথায়? ওই মক্তবেই বরং একটা চাকরি করে দাও। তাই হলো। সেইসঙ্গে পিতার শূন্যস্থান পূরনে মাজারের খাদেমগিরি আর মসজিদের ইমামতি। বাচ্চা মোল্লা হিসেবে দুখু মিঞা মানিয়ে গেল বেশ। উপায়-উপার্জন একটু-আধটু হতে লাগল বৈকি।
নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান রপ্ত করতে করতে, নিজের সমাজকে দেখতে দেখতে জানতে জানতে ছেলেটি বড় হয়।
সূত্র : নজরুল ইসলাম কিশোর জীবনী
প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর